ঢাকা,সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

গণধর্ষণের সাক্ষ্য দিলেন ৫৩ রোহিঙ্গা নারী

নিউজ ডেস্ক ::

মিয়ানমার সেনা ও উগ্র বৌদ্ধদের হাতে গণধর্ষণের শিকার ৫৩ নারী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। জাতি সংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারে ওসব ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে ওই সাক্ষ্য নিচ্ছে মানবাধিকার কমিশন।

এ উপলক্ষে গত ১ থেকে ৩রা ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া ৫৩ নারীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন সংস্থাটির ৪ টিমের ১৬ সদস্য। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মানবজমিনকে বলেন, মিয়ানমারে ওই ৫৩ রোহিঙ্গা নারী অবর্ণনীয় ও অবিশ্বাস্য নির্মমতায় ধর্ষণের শিকার হওয়ার লোমহর্ষক সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইউনিফরম পরিহিত মিয়ানমার সেনা সদস্যদের হাতে তারা ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কিছু উগ্র বৌদ্ধদের দ্বারাও এমন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। এসব মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উত্থাপনের জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে ওই সব সাক্ষ্যগ্রহণ করা হচ্ছে। এভাবে মোট ৫০০ নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষ্য নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এরপর জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে দায়ীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উত্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হবে।

জামাকন ও সাক্ষ্যগ্রহণ টিমের সদস্যরা জানান, গত ২৫শে আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা ও উগ্র বৌদ্ধদের রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যা শুরু হয়। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর জীবন বাঁচাতে দলে দলে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। গত সেপ্টেম্বরের প্রথম থেকে জামাকন তাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শুরু করে। স্বদেশ ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের মুখে ভয়াবহ গণহত্যা ও গণধর্ষণের বর্ণনা পাওয়া যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে জামাকন অপরাধীদের যাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা যায়, সেই লক্ষ্যে ভিকটিমদের সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেছে। মালয়েশিয়া, ওআইসি ও আশিয়ানেও চিঠি দিয়ে মিয়ানমারে ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে জানায় সংস্থাটি। আলাপ-আলোচনা করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।

‘ইউএন ওমেন’ এর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ইউএনডিপি বিশেষজ্ঞ ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উত্থাপন যোগ্য প্রশ্নপত্র তৈরি করে এই সাক্ষ্য ও আলামত সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা হয়। গত ১ থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি তিন দিন ধরে ৪ টিমের প্রতিটিতে ৪ জন করে ১৬ মানবাধিকারকর্মী উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থান করে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। সংগ্রহ করেন ধর্ষণের আলামত। এ সময় ভিকটিম নারীদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ও তাদের সম্মতি সাপেক্ষে আলাদা স্থানে নিয়ে কথা বলা হয়। এছাড়া ভোক্তভোগীর পরিবারের সদস্য ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও কথা বলা হয়।

সেই সঙ্গে তারা অবস্থান নেয়া ক্যাম্পের মাঝি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসন, মেডিকেল অফিসারের সঙ্গেও কথা বলেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের সবার বক্তব্যে ওই নারীরা ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হওয়ার স্বপক্ষে সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।
রোহিঙ্গা নারীরা জানান, তাদের কাউকে নিজ বাড়িতে আর কাউকে স্থানীয় স্কুল ও সেনা ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইউনিফরম পরিহিত মিয়ানমার সেনারা ধর্ষণ ও গণধর্ষণ করেছে। ওই ৫৩ নারীর অধিকাংশই কয়েকজনের দ্বারা ধর্ষণের শিকার।

কারো কারো বাবা-মা’কে তাদের সামনে মেরে ফেলা হয়েছে। কারো নবজাতককেও হত্যা করা হয়েছে। নিজের ও পরিবারের উপর এমন নৃশংসতার পরই তারা মিয়ানমার ছাড়ে। একজনের সামনে অন্যজনকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করতে করতেই মেরে ফেলা হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওই টিমের এক সদস্য হলেন জনসংযোগ কর্মকর্তা ফারহানা সাঈদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, সাক্ষ্য নেয়া নারীদের সবাই ভয়াবহ যৌন সহিংসতার শিকার। অধিকাংশই কয়েকজনের হাতে ধর্ষিত হয়েছে। সশস্ত্র অভিযানের মধ্যে ইউনিফরম পরা অবস্থায় সেনা সদস্যরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের অনেকে সহিংস যৌন হয়ারানির পর ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

পাঠকের মতামত: